বান্দরবানে অসাধারণ এক ট্যুরের গল্প - রুমা, বগালেক, সাঙ্গু নদীর অপার সৌন্দর্য
সাল ২০১৭, ডিসেম্বর মাস। ভার্সিটি এর ফার্স্ট ইয়ার শেষ প্রায়। তখন পর্যন্ত কক্সবাজার, সিলেট ছাড়া আর তেমন কোথাও যাওয়া হয়নি। টিকটক, ফেসবুক রিলস না থাকায় ঘুরাঘুরি তখনও খুব বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। বান্দরবানের পাহাড়ি সৌন্দর্য ছিল অনেকেরই অজানা। শুধু যারা যেত তারাই পাহাড়, মেঘ আর সাঙ্গুর প্রেমে পড়ত। আমরাও টুকটাক কিছু ছবি ভিডিও দেখে সেইবার বান্দরবান যাওয়ার প্ল্যান করি। তখন মাত্র সাঙ্গু নদীর পাড়ের থানচি নামের একটা জায়গার নাম শোনা যাচ্ছিলো। আমরাও সেখানে যাব প্ল্যান করি। আর কোন প্ল্যান নাই।
যাওয়ার আগে আগে আমাদের একজন থানচি কুটির নামের রিসোর্টে রুম বুকিং দেয় । টাকাও অ্যাডভান্স করে। আমরাও ট্যুরে চলে যাই। সকালে বান্দরবানের বাস স্ট্যান্ডে নেমে পাশেই একটা টিনের হোটেল থেকে নাস্তা করে নেই। এখন সেখানে অনেক অনেক বাস কাউন্টার। নাস্তা করে আমরা চান্দের গাড়ির স্ট্যান্ডে যাই। শৈলপ্রপাত, চিম্বুক পাহাড়, নীলগিরি দেখে আমরা থানচি যাব। এই প্ল্যান করে চান্দের গাড়ি নেই। প্রথমবার পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে চান্দের গাড়ি দিয়ে যাওয়া। সারা রাতের জার্নির টায়ারডনেস এক মুহূর্তে চলে গেল। যতই উপরে উঠতে থাকি ততই মুগ্ধতা। সাগর নাকি পাহাড়ের প্রশ্নে সেদিন অকপটে পাহাড়ের দিকে ঝুকে গেলাম।
শৈলপ্রপাত দেখে চিম্বুক পাহাড়ের দিকে যাওয়ার সময় মাঝে একটা জায়গায় অসংখ্য সাদা মেঘ দেখে মামাকে গাড়ি থামাতে বললাম। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে নিচে সারি সারি সাদা মেঘ দেখার সেই মুহূর্তটা এখনও মনে আছে। এরপর প্রথমবার চিম্বুক পাহাড়ের ভিউ পয়েন্টে গিয়ে সারি সারি পাহাড় দেখা। দূরে পাহাড়ের গায়ে মেঘের ছায়ার মত সুন্দর দৃশ্য যেন খুব কমই আছে।
Y জাংশন পার হয়ে আমরা নীলগিরির দিকে যেতে থাকি। আরও উপরে উঠতে উঠতে আমাদের কয়েকজনের একটু খারাপ লাগা শুরু হয়। নীলগিরি গিয়ে সবাই নেমে দেখিও নাই। চান্দের গাড়িতে শুয়ে কিছুক্ষণ এনার্জি ফিরে পাবার চেষ্টা। এরপর হুট করে সেখানে সবার ইচ্ছা হয় যে বগালেক যাওয়া হবে। বগালেক তখন ক্রাউন জুয়েল অফ বান্দরবান। মাত্র দেখে ঢাকায় যাওয়া এক বন্ধুর কথা 'বান্দরবান গিয়ে বগালেক না দেখলে পুরাই মিস'। তাই সবাই মিলে তখন মাঝ রাস্তায় ট্যুর প্ল্যান চেঞ্জ। যাওয়া হবে বগালেক।
সময় তখন দুপুর পেরিয়ে বিকেলের শুরু। ঐদিন রাতেই বগালেক পৌঁছে সেখানে থাকা হবে। পরদিন যাব কেউক্রাডং। সে সময় বগালেক যেতে হয় ট্র্যাকিং করে বিশাল এক পাহাড় চড়ে। আমাদের তেমন আইডিয়া নাই। তাই অজানা দুঃসাহস করে রওনা দিয়ে দিলাম গাড়ি ঘুরায়ে রুমা বাজারের দিকে। আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে বিকেলের দিয়ে পৌছাই রুমা বাজার।
সেখানে গিয়ে বগালেক যাব বলে চান্দের গাড়ি ঠিক করতে গেলেই কেউ রাজি হয় না। গাইড নিতে হবে তাও জানা ছিলো না। একজন পরামর্শ দিলো না যাওয়ার। ট্র্যাকিং করতে হবে রাতের আঁধারে, তাও খাড়া পাহাড় বেয়ে। জীবনে কখনও পাহাড়ে না উঠা আমরা ৯ জন যেন তাও যাব এরকম একটা ভাব। কিন্তু পরে গাইড নেয়া আর সেনাবাহিনীর পারমিশনের কথা শুনে সবাই ঐদিন রাত রুমা বাজারেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
রুমা বাজারে তখন সেরকম কোন হোটেল নাই। একটা দুইটা আছে হোটেল না ঠিক। কোন রকম থাকার জায়গা। এরকমই একটা জায়গায় একটা বড় রুমে ৯ জন থাকব আমরা। পুরো রুম জূরে নিছে ফ্লোরিং বেড হবে। সিরিয়াল ধরে ৯ জন শুয়ে পড়া। আর এই রুমের ভাড়া ছিলো ৯০০ টাকা! জন প্রতি মাত্র ১০০ টাকা! এ টাকায় আজকাল কোথাও থাকা আর সম্ভব না।
এরপর পরদিন সকাল সকাল উঠে আমরা যাই পাশের সাঙ্গু নদীর পাড়ে। শীতের কুয়াশাঘেরা সাঙ্গু নদী দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। তার চেয়েও বেশি মোহনীয় লাগে কুয়াশার চাদরে ঘেরা পাহাড় দেখে। আরেকবার পাহাড়ের প্রেমে পড়া। সকালটা কিছুক্ষণ নদীর পাড়ে কাটিয়ে আমরা রেডি হই বগালেক যাওয়ার জন্য। গাইড একজনকে নিয়ে ফর্ম ফিল আপ করে তারপর সেনাবাহিনীর কাছে থেকে পারমিশন নিয়ে আমরা রওনা দেই বগালেকের উদ্দেশ্যে।
তখনও পুরো রাস্তা হয়নি বগালেক যাওয়ার। কিছু কিছু জায়গায় পাহাড় কেটে রাস্তা করা হচ্ছে। সেদিক দিয়ে যেতে পাহাড়ের খাদে পড়ে যাবার ভয়। এসব এর মাঝেই বগালেকের পাশের পাহাড়ের প্রায় ১ কিলোমিটার আগে চান্দের গাড়ি থামিয়ে আমাদের ট্রেকিং শুরু। ততক্ষণে ডিসেম্বর এর সকালের কুয়াশা কাটিয়ে আকাশে তেজদীপ্ত সূর্য। হালকা ঠাণ্ডায় সে সূর্যের রোদ কিছুটা ভালো লাগলেও ৫ মিনিট হাঁটার পরই গরম লাগা শুরু। মনে হচ্ছিলো হঠাৎ এপ্রিল মাস চলে এসেছে। বৈশাখ চলে।
কিছুদূর হাঁটার পর আমরা পৌছাই পাহাড়ের পাদদেশে। সেখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের চূড়া দেখা যায় না। এই পাহাড়ের ওপারেই বগালেক। শুরু করলাম পাহাড় ট্রেকিং। ২০-২৫ মিনিট পরই এক একজনের অবস্থা খারাপ। সব এনার্জি শেষ। সারা বছর ক্লাস করে পুরো আনফিট হয়ে যাওয়া ৯ জন। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হওয়া কয়েকজনের একজন ছিলাম আমি। অর্ধেক উঠার পর বাকি অর্ধেক পথ দেখি একদম খাড়া। তখন মনে হচ্ছিলো এসব জায়গায় হেলিকপ্টার আর ক্যাবল কার থাকা খুব জরুরি।
তবে ব্রেক নিয়ে নিয়ে উঠে যাই সেই পাহাড়ের চূড়ায়। উঠেই দেখি ছোটখাট একটা পাহাড়ি গ্রাম, আর্মি ক্যাম্প আর তারপাশে অসম্ভব সুন্দর বগালেক। আর্মি ক্যাম্পে নাম লিখিয়ে খাবার অর্ডার দিয়ে আমরা নেমে পড়ি বগালেকে। চারপাশে সবুজ পাহাড় আর মাঝখানে এই লেক। সুন্দর স্বচ্ছ পানির বগালেক। পানিতে নেমে দেখি ছোট ছোট মাছ একদম পায়ের কাছে এসে ঠোকর খাচ্ছে। তখন মাথায় আসে যে এতো উঁচুতে লেকে এখানে মাছ আসলো কথা থেকে।
এভাবেই বগালেকে সুন্দর একটি দিন কাটিয়ে আমরা সন্ধায় রুমা বাজার ফিরে আসি। সেবারের মত আর ক্রেওক্রাডং যাওয়া হয়নি। তবে রুমা বাজারে থাকা দুইদিনের প্রতিটা সময় উপভোগ করি। সেখানকার সকাল বেলার বাজার আর বাজারের পাশে দিয়ে যাওয়া সাঙ্গু নদীর তীরে লোকালদের সাথে ফুটবল খেলে ৭-৮ টা গোল খাওয়া, সব কিছুই এখনও স্মৃতির পাতায় স্পষ্ট।
এরপর আরও ৫ বার বান্দরবান গেলেও প্রথমবারের এই অভিজ্ঞতাটাই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগার ছিলো বলে মনে হয়। আরও অনেকবার হয়ত বান্দরবান যাওয়া হবে, তবে Most Memorable হিসেবে এটাই থেকে যাবে।